প্রকাশিত:
২৪ জুন ২০২৪, ১২:০৪
বন অধিদপ্তরের বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের হটলাইনে জামালপুরের এক ব্যক্তি ফোন করেন। হোয়াটসঅ্যাপে একটি মৃত সাপের ছবি পাঠিয়ে তিনি বলেন, ‘আমার বাড়ির আশপাশে বহু রাসেলস ভাইপার ঘুরছে। এর একটি ঘরে ঢুকলে মেরে ফেলেছি। রাসেলস ভাইপার থেকে আমাদের উদ্ধার করুন।’
রোববার তাঁর পাঠানো ছবি পর্যবেক্ষণ করে বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের পরিদর্শক অসীম মল্লিক সঙ্গে সঙ্গে জানান, এটি বিষধর নয়, প্রকৃতির জন্য খুবই উপকারী সাপ।
এ বিষয়ে অসীম বলেন, ‘আমরা বলার পরও জামালপুরের ওই ব্যক্তি সাপটি রাসেলস ভাইপার বলেই যাচ্ছিলেন। এক পর্যায়ে গুগল থেকে একই রঙের সাপের ছবি নামিয়ে নাম যুক্ত করে পাঠালে তিনি আশ্বস্ত হন।’
দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়া রাসেলস ভাইপার আতঙ্কে বন অধিদপ্তরের বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট পাঁচটি হটলাইন চালু করে। প্রতিটি নম্বরে ঘণ্টায় গড়ে ৪০টি করে কল আসে। দেশের বাইরে থেকেও কেউ কেউ কল করে সাপের সন্ধান দিচ্ছেন। অনেকে আবার সাপ মেরে কল করে পুরস্কারের টাকা চাচ্ছেন।
হোয়াটসঅ্যাপে ছবি ও ফোনের তথ্য যাচাই করে বন বিভাগ দেখেছে, হত্যার শিকার ৮০ শতাংশ সাপই নির্বিষ। এখন পর্যন্ত মেরে ফেলা সাপের একটিও রাসেলস ভাইপার নয়। ইউনিটের পরিচালক ছানাউল্যাহ পাটোয়ারীসহ পাঁচ কর্মকর্তা সাপ নিয়ে বিচিত্র অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হচ্ছেন।
ছানাউল্যাহ বলেন, প্রতি মিনিটে কল আসছে। একটি কলে কথা বলা অবস্থায় আরও ২-৩টি কল আসছে। অধিকাংশ মানুষই আতঙ্কে কল করছেন। কেউ কেউ সাপ দেখলে কী করবেন, জানতে চাচ্ছেন। আমরা তথ্যদাতা থেকে হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে ছবি এনে দেখেছি– এখন পর্যন্ত হত্যার শিকার সাপের মধ্যে একটিও রাসেলস ভাইপার নেই। প্রায় সবই নির্বিষ এবং পরিবেশের জন্য উপকারী।
ইউনিটের পরিদর্শক অসীম মল্লিক জানান, গত তিন দিনে ঘণ্টায় প্রতিটি নম্বরে ৪০ থেকে ৫০টি কল এসেছে। অনেকেই আতঙ্কে কল করে সমাধান চাচ্ছেন। সৌদি আরব, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমানসহ বিভিন্ন দেশ থেকে প্রবাসীরা ফোন করে তাদের বাড়িতে সাপের উপস্থিতির কথা জানাচ্ছেন। সবচেয়ে বেশি আতঙ্কে এবং করণীয় কী জানতে চেয়ে কল করছেন। তথ্যদাতাকে ছবি পাঠাতে বললে কেউ সাপ মেরে, কেউ জ্যান্ত সাপের ছবি দিচ্ছেন। এমন ছবিতে ফরিদপুরে মৃত সাপটিও রাসেলস ভাইপার নয়। গুজবে মানুষ নিরীহ এবং প্রকৃতির জন্য উপকারী সাপ মেরে ফেলছে। কলদাতাকে সাপকে না মেরে তাড়িয়ে দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের পরিচালক বলেন, রাসেলস ভাইপার বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ প্রকৃতি থেকে তার খাদ্য কমে গেছে। এখন রাসেলস ভাইপার নিয়ন্ত্রণের নামে যেগুলো মারা হচ্ছে, এর মধ্যে ঘরগিন্নি, অজগর, দাঁড়াশ, শঙ্খিনীসহ বিভিন্ন প্রজাতির সাপ রয়েছে। এদের অধিকাংশেরই খাদ্য রাসেলস ভাইপার। তারা রাসেলস ভাইপারকে খেয়ে নিয়ন্ত্রণে আনে। অথচ হুজুগে মানুষ উপকারী সাপও মেরে ফেলছে। আমরা হটলাইনে কল করা সবাইকে অনুরোধ করছি, সাপ না মেরে, তার মতো থাকতে দিতে। কোনো সাপ নিজের জন্য কাউকে হুমকি মনে না করলে আক্রমণ করে না। আর রাসেলস ভাইপার গাছেও ওঠে না, ঘরেও আসে না। ফসলের জমিতে যাওয়ার সময় একটু সচেতনতা অবলম্বন করলেই রাসেলস ভাইপারের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেকাংশে কমে যায়। আমরা মনে করছি, মানুষ যে সচেতন হয়েছে, এটা ভালো দিক। তবে সাপ হত্যা বন্ধ করতে হবে।
সাপের বিষ নিয়ে গবেষণা করা প্রতিষ্ঠান ভেনম রিসার্চ সেন্টার এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, গুজবের ক্ষেত্রে পুরোনো ছবি ব্যবহার করা হচ্ছে। যেখানে রাসেলস ভাইপার থাকার কোনো সম্ভাবনা নেই, সে জায়গারও ছবিতে সাপটি দেখানো হচ্ছে। এমন সব প্রজাতির সাপের ছবি প্রচার করা হচ্ছে, যার কোনো অস্তিত্বই বাংলাদেশে নেই। সামাজিক মাধ্যমে রাসেলস ভাইপার নিয়ে কোনো পোস্ট দেওয়ার আগে জেনেবুঝে করতে পরামর্শ দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
চন্দনাইশ (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি জানান, চট্টগ্রামের চন্দনাইশের পাহাড়ি অঞ্চল ধোপাছড়ি ইউনিয়নের চিরিংঘাটা এলাকায় গতকাল বেলা ১১টার দিকে রাসেলস ভাইপার সন্দেহে পিটিয়ে মারা হয় চারটি সাপ। এর মধ্যে দুটি দাগি ঢোঁড়া জাতীয় বিষহীন সাপ বলে জানিয়েছেন বন বিভাগের দোহাজারী রেঞ্জের রেঞ্জার রেজাউল করিম। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মিউনিসিপ্যাল মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে রোববার সকালে একটি নির্বিষ ঘরগিন্নি সাপ পিটিয়ে মারা হয়েছে। এর আগে শনিবার লোহাগাড়ায় একটি অজগর পিটিয়ে মারা হয়।
সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুরে এক জেলের জালে ধরা পড়া নির্বিষ ও শান্ত স্বভাবের বার্মিজ পাইথন বা অজগরের বাচ্চাকে ইচ্ছে করে রাসেলস ভাইপার বানিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টির অভিযোগ উঠেছে। বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা শুরু হলে ফেসবুকের যে পেজ থেকে অপপ্রচার চালানো হয়, সেখানে লাইভে এসে উপজেলা ও পুলিশ প্রশাসন জানায়, সাপটি রাসেলস ভাইপার নয়। অজগরের বাচ্চা। এ সময় পেজটি যারা পরিচালনা করেন, তাদের ধন্যবাদ দেন বিশ্বম্ভরপুর থানার ওসি শ্যামল বণিক।
মন্তব্য করুন: