রবিবার, ৪ঠা মে ২০২৫, ২০শে বৈশাখ ১৪৩২ | ই-পেপার
ব্রেকিং নিউজ:
  • সারাদেশে জেলা ও উপজেলা প্রতিনিধি নিয়োগ করা হচ্ছে। আগ্রহী হলে আপনার সিভি ই-মেইল করতে পারেন। ই-মেইল dailyvobnews@gmail.com
সংবাদ শিরোনাম:
  • পাকিস্তান থেকে সব ধরনের আমদানি নিষিদ্ধ করল ভারত
  • মহাসমাবেশ থেকে হেফাজতের নতুন কর্মসূচি ঘোষণা
  • চাঁদপুরে ২ শিশু শিক্ষার্থীকে যৌন হয়রানির অভিযোগে শিক্ষক গ্রেপ্তার
  • আরও ১ লাখ ১৫ হাজার রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ
  • সরকারের হস্তক্ষেপ না থাকায় গণমাধ্যম সূচকে ১৬ ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ
  • শরীয়তপুরে আওয়ামী লীগ-বিএনপির পাল্টাপাল্টি মিছিল
  • করিডর দেওয়ার সিদ্ধান্ত আসতে হবে নির্বাচিত সংসদ থেকে
  • আ. লীগ নিষিদ্ধসহ ১২ দফা দাবি হেফাজতের
  • সন্ধ্যায় ঢাকায় আসছেন কানাডার বাণিজ্য প্রতিনিধি
  • আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক দল নয় সন্ত্রাসী সংগঠন

চট্টগ্রামে বলীখেলার প্রচলন যেভাবে

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশিত:
২৬ এপ্রিল ২০২৫, ১৪:২৫

বলীখেলা এ অঞ্চলের আদি অকৃত্রিম একটা ঐতিহ্য। আগে পাড়ায় পাড়ায়, অর্থাৎ বিভিন্ন থানা এলাকায় এ আয়োজন ছিল। সাধারণত জ্যৈষ্ঠ ও বৈশাখ মাসে খালি জমিতে আয়োজন করা হতো বলীখেলা। অনেক জায়গায় বলীখেলার পাশাপাশি গরুর (ষাঁড়) লড়াইও হতো। কালক্রমে বলীখেলা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। তবে এখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে লালদীঘি মাঠের শতবর্ষী আবদুল জব্বারের বলীখেলা।

বলীখেলা চট্টগ্রামের আঞ্চলিক নাম। এটাকে কুস্তি বা মল্লযুদ্ধ প্রতিযোগিতাও বলা হতো। প্রচলিত, অর্থাৎ আন্তর্জাতিক কুস্তি প্রতিযোগিতার সঙ্গে এর মিল পাওয়া ভার। এই বলীখেলা হয়ে আসছে পুরোপুরি গ্রামীণ নিয়মকানুনে। নির্মল বিনোদনই কেবল নয়, শোষণকারীদের বিপক্ষে শক্তিমত্তা প্রদর্শনের জন্য নিজেকে কিংবা সমাজকে তৈরি করার প্রচেষ্টাও ছিল এই মল্লযুদ্ধে।

আবদুল হক চৌধুরীর ‘চট্টগ্রামের সমাজ ও সংস্কৃতির রূপরেখা’ বইয়ে উল্লেখ করা হয়, ‘মল্লযুদ্ধে চট্টগ্রামের ঐতিহ্য সুপ্রাচীনকালের। চট্টগ্রামে মল্ল নামে খ্যাত বহু সুপ্রাচীন হিন্দু-মুসলমান পরিবার দেখা যায়। চট্টগ্রামের ২২টি মল্ল পরিবার ইতিহাস বিখ্যাত। তাঁরা সবাই মধ্য চট্টগ্রাম, অর্থাৎ কর্ণফুলী ও শঙ্খ নদের মধ্যবর্তী এলাকার ২০ গ্রামের লোক ছিলেন।

আশিয়া গ্রামের আমান শাহ মল্ল, চাতরি গ্রামের চিকন মল্ল, কাতারিয়া গ্রামের চান্দ মল্ল, জিরি গ্রামের ঈদ মল্ল ও নওয়াব মল্ল, পারি গ্রামের হরি মল্ল, পেরলা গ্রামের নানু মল্ল, পটিয়ার হিলাল মল্ল ও গোরাহিত মল্ল, হাইদগাঁওর অলি মল্ল ও মোজাহিদ মল্ল, শোভনদণ্ডীর তোরপাচ মল্ল, কাঞ্চননগরের আদম মল্ল, ঈশ্বরখাইনের গনি মল্ল, সৈয়দপুরের কাসিম মল্ল, পোপাদিয়ার যুগী মল্ল, খিতাপচরের খিতাপ মল্ল, ইমামচরের ইমাম মল্ল, নাইখাইনের বোতাত মল্ল, মাহাতার এয়াছিন মল্ল, হুলাইনের হিম মল্ল, গৈরলার চুয়ান মল্ল।’

মল্লযুদ্ধ কখন বলীখেলা নামে পরিবর্তিত হয়েছে, তা জানা নেই জানিয়ে বইটিতে উল্লেখ করা হয়, প্রাচীনকাল থেকে এ অঞ্চলের প্রতি জেলায় হাতে গোনা কুস্তি প্রতিযোগিতা বা মল্লযুদ্ধ আয়োজন হতো। চট্টগ্রামের মতো দুই মাস ধরে বলীখেলা আর কোথাও হতো না। মল্লরা সাধারণত খুব সুঠামদেহী এবং শক্তিশালী হতেন।

ঢোলবাদনের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন পাড়া থেকে বলীরা খেলার স্থানে ভিড় করতেন। যাঁরা বলীখেলা দিতেন, তাঁরা সোনার অথবা রুপার মেডেল পুরস্কার হিসেবে রাখতেন। মাটি খুঁড়ে ধুলাময় করে রিং তৈরি করা হতো, যাতে বলীরা ব্যথা না পান। এক বলী অপরজনকে মাটিতে ফেলে দিতে পারলেই শুধু হতো না, পিঠ মাটিতে ছোঁয়াতে পারলেই বিজয়ী ঘোষণা করা হতো। তখন বিজয়ীর গলায় মেডেল পরিয়ে দেওয়া হতো। বিজয়ী বলীর নাচও ছিল দর্শনীয়। বাদ্যের তালে তালে কোমর দুলিয়ে নাচতে নাচতে বাড়ি ফিরতেন তাঁরা।

চট্টগ্রামের বলীখেলা প্রতিযোগিতার বেশির ভাগই ছিল মানুষের নামে। যে ব্যক্তি আয়োজক থাকতেন মূলত তাঁর নামেই প্রতিযোগিতা প্রচলিত হতো। তবে এর বাইরেও হাটহাজারীর বলীখেলা, ফতেপুরের বলীখেলা, পটিয়ার বলীখেলা, মক্কার বলীখেলা ইত্যাদি জনপ্রিয় ছিল। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থাকার সময় সাহিত্যিক আবুল ফজল সেখানে বলীখেলার প্রবর্তন করেছিলেন। এতে ছাত্ররাও অংশ নিতেন। তবে তা কয়েক বছর পর বন্ধ হয়ে যায়।

আবদুল হক চৌধুরীর ভাষ্য অনুযায়ী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে আস্তে আস্তে বলীখেলা কমতে থাকে। এখনো দু–একটি বলীখেলা সগৌরবে আয়োজিত হয়। তার মধ্যে জব্বারের বলীখেলা অন্যতম। ছয় দফার মাঠ লালদীঘি ময়দানে এই বলীখেলা অনুষ্ঠিত হয়। যদিও বলীখেলার শুরুর সময়ে এ মাঠ ঐতিহাসিক হয়ে ওঠেনি।

বদরপাতির আবদুল জব্বার সওদাগর ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যুবসমাজকে উদ্বুদ্ধ করতে এই বলীখেলার প্রচলন করেছিলেন। বিপ্লবী পূর্ণেন্দু দস্তিদারের ‌‘স্বাধীনতা সংগ্রামে চট্টগ্রাম’ বইতে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিপ্লবের আগে প্রস্তুতির অংশ হিসেবে অনুশীলন সমিতির বলীখেলাসহ বিভিন্ন শক্তি ও নৈপুণ্য প্রদর্শনের খেলার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

পূর্ণেন্দু দস্তিদার লিখেছেন, ‘১৮৯৯-১৯০১ সালের কলকাতায় তরুণ ব্যারিস্টার প্রমথনাথ মিত্রের উদ্যোগে বাংলার প্রথম গোপন বিপ্লবী দল “অনুশীলন সমিতি” প্রতিষ্ঠিত হয়। অনুশীলন সমিতিতে লাঠিখেলা, অসি খেলা, ছোরা খেলা, কুস্তি, মুষ্টিযুদ্ধ ইত্যাদি শিক্ষা দেওয়া হতো। পাশাপাশি চরিত্র গঠনের শিক্ষাও দেওয়া হতো।’

শোষকের বিরুদ্ধে শক্তি প্রদর্শনের ভাবনা থেকে প্রচলিত জব্বারের বলীখেলা কালক্রমে এ অঞ্চলের প্রাণের খেলা ও মেলায় পরিণত হয়েছে। প্রতিবছর ১২ বৈশাখ এই বলীখেলা অনুষ্ঠিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় একবার এবং কোভিড-১৯–এর কারণে দুই বছর বলীখেলা হয়নি। এবার ১১৬ বছরে পা রাখল এই বলীখেলা।

বলীখেলা উপলক্ষে যে প্রাণের সঞ্চার হয়, তা অভাবনীয়। গ্রামীণ এ খেলা দেখার জন্য গতকাল শুক্রবার লালদীঘি মাঠ ঘিরে যে ভিড় দেখা গেছে, তাতে মনে হতে পারে, ফুটবল-কাবাডিকে ছাপিয়ে গেছে এ আয়োজন। এবার পাহাড়িদের সাংগ্রাই উৎসবেও বলীখেলা হতে দেখা গেছে রাঙামাটিতে। সেখানে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও অংশ নিয়েছেন। কক্সবাজার অঞ্চলে ডিসির বলীখেলাসহ কয়েকটি বলীখেলা হয় এখনো। সাতকানিয়ায় মক্কার বলীখেলাও হয়। তবে জৌলুশে অদ্বিতীয় জব্বার মিয়ার বলীখেলা।

বলীখেলাকে ঘিরে লালদীঘি মাঠের চার বর্গকিলোমিটার এলাকায় মেলা বসে। তাতে কী পাওয়া যায় না—গৃহস্থালির সামগ্রী, দা-খুন্তি, ঝাড়ু, হাতপাখা, চারা, শীতলপাটি, আসবাব, গজা, মোয়া—কী নেই! খেলা আর মেলার টানেই ছুটে আসে দূরদূরান্তের মানুষ। আজ শেষ হবে মেলা। আবদুল জব্বারের নাতি ও বলীখেলা কমিটির সদস্যসচিব শওকত আনোয়ার বলছিলেন, ‘এখনো বলীখেলা উপলক্ষে এখানে বাপের বাড়িতে মেয়েরা নাইয়োর (বেড়াতে) আসে। এটা একটা ঐতিহ্য এখানকার।’

সত্যি তা–ই, প্রাণের মেলায় পরিণত হয় এলাকাটি। তিন দিনের হলেও কয়েক দিন আগে থেকেই ব্যবসায়ীরা আসতে থাকেন। পেশা ও নেশার টানে সবাই ছুটে আসে এই বলীখেলার মেলায়। এই যেমন বছরের পর বছর বাঁশের কঞ্চি দিয়ে বেহালা বানিয়ে তা মেলাজুড়ে বাজিয়ে চলেন সালাহউদ্দিন।

শুক্রবার বলীখেলার আগের দৃশ্য, সালাহউদ্দিন তাঁর নিজস্ব বেহালায় সুর তুলে ছুটছেন মেলায়। তাঁকে অনুসরণ করে ছুটে চলছেন উৎসুক শিশু-কিশোর-তরুণেরা, যেন হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা। কেউ ছবি তুলছেন, কেউ ভিডিও করছেন সালাহউদ্দিনের। কেউবা বেহালার সুরে সুরে গাইছেন, ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম...গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু মুসলমান।’


মন্তব্য করুন:

সম্পর্কিত খবর