প্রকাশিত:
২৬ এপ্রিল ২০২৫, ১৫:১৭
ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্রথম ব্যাচের ছাত্র ছিলেন ফজলুল করিম পাঠান। কর্মজীবনের ৪০ বছরের বেশি সময় এক নিভৃত পল্লিতে অতিবাহিত করে গেছেন তিনি। মৃত্যুর পর আজও নরসিংদীর চরসিন্দুর ইউনিয়ন তথা পলাশ উপজেলা আর আশপাশের মানুষের স্মৃতিতে বেঁচে আছেন। ওই চিকিৎসকের নানা ধরনের বিচিত্র শখ ছিল। শিকার করতে ভালোবাসতেন। চেম্বারে বিভিন্ন বয়সের মানবভ্রূণ, মানুষের শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ফরমালিনের সাহায্যে সংরক্ষণ করে রাখতেন। অতিপ্রাকৃত বিষয়েও ছিল তাঁর বিশেষ আগ্রহ। বিচিত্র মানুষের প্রতি ছিল তাঁর দুর্বার আকর্ষণ।
একবার এক কিশোর তাঁর মনোজগতে রীতিমতো ঝড় তুলেছিলেন। সময়টা ১৯৮৫ সাল, চরসিন্দুর গ্রামের মোসলেউদ্দিন দফাদার ও তাঁর স্ত্রী খয়তুন্নেসা তাঁদের সন্তান রহমতউল্লাহকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে আসেন তাঁর কাছে। ছেলেটির কাহিনি শুনে রীতিমতো চিন্তায় পড়ে যান চিকিৎসক।
মানবশিশু জন্মের পর একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত মাতৃদুগ্ধ পান করে। তারপর আস্তে আস্তে তাকে অন্যান্য খাবারে অভ্যস্ত করে তোলা হয়ে থাকে। বিশেষত বাঙালি মানেই দুধের পর ভাত খেতে শুরু করে। এই ছেলেটিকে যখন প্রথম নরম ভাত খাওয়ানো শুরু করা হয়, তখনই ঘটে বিপত্তি। বমি করে বারবার ভাত উগরে দিতে থাকেন। প্রথমে সবাই ভেবেছিলেন, আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু না, বছরের পর বছর চেষ্টা করেও তাঁকে ভাত খাওয়ানো যায়নি। ভাত পেটে গেলেই বমি করে দিতেন। অন্য খাবারের ভেতরে গোপনে ভাত ভরে খাওয়ালেও একই অবস্থা। মা-বাবা ছেলেটিকে নিয়ে ভীষণ চিন্তায় পড়ে যান। বহু পীর–ফকিরের দরগায় তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়, করা হয় কবিরাজি চিকিৎসা, ওঝা ডেকে ঝাড়ফুঁক। কোনো কিছুতেই লাভ হয়নি।
ফজলুল করিম পাঠানের ধারণা, অসুখটা তাঁর মনের। কোনো বিশেষ ঘটনা থেকে তাঁর মনে ভাতের প্রতি বিতৃষ্ণা জন্মেছে। তিনি তাঁকে কোনো চিকিৎসা দিলেন না। বরং ছেলেটি হয়ে উঠলেন তাঁর আদরের পাত্র। মাঝেমধ্যেই ডাক্তারের চেম্বারে আসতেন। ডাক্তার সাহেব সবাইকে সেই অদ্ভুত বালকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে একধরনের আনন্দ অনুভব করতেন। বরিশালের মোস্তফা বলেন, ‘আমার নৌকায় উঠে অনেকেই বলে, বিমানে উঠছিলাম’
কৈশোরে আমিও সেই ছেলেকে অবাক বিস্ময়ে দেখতাম। কী অদ্ভুত বালক, ভাত না খেয়ে কী করে থাকে? নানা প্রশ্ন মাথায় ভিড় করত। মাঝেমধ্যে আমাদের বাড়িতেও আসতেন। তবে সেই আসা-যাওয়ার ছন্দপতন ঘটে ১৯৯৩ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর; আমার বাবা (ও, বলতে ভুলে গেছি, ফজলুল করিম পাঠান আমার বাবা) যেদিন মারা যান। এরপর কালেভদ্রে তাঁর সঙ্গে দেখা হতো।
কিছুদিন আগে রহমতউল্লাহর সঙ্গে আবার দেখা। তিনি এখন ৫৪ বছর বয়সী একজন মানুষ। কথা বলে জানা গেল, স্বভাব তাঁর আগের মতোই আছে, এখনো ভাতে ভীষণ অরুচি। তিন বেলাই রুটি খেয়ে থাকেন। তাঁর সঙ্গে চরসিন্দুর বাসস্ট্যান্ড–সংলগ্ন তাঁদের বাড়িতে যাই। তাঁর মা-বাবা আর বেঁচে নেই। সেখানে নবীন-প্রবীণ অনেকের সঙ্গে কথা হলো। সবার কাছেই রহমতউল্লাহ এক আজব মানুষ, ভাত যে খেতেই পারেন না। নরসিংদীর মাসুদ সাইকেল নিয়ে ঘুরছেন আফ্রিকার দেশে দেশে, ছেড়েছেন ব্যবসা
মন্তব্য করুন: