প্রকাশিত:
৩০ এপ্রিল ২০২৫, ১৮:১০
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও ইউনিসেফের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত ‘মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে ২০১৯’ অনুযায়ী, বাংলাদেশের এক থেকে ১৪ বছর বয়সী ৮৯ শতাংশ শিশু জরিপ পূর্ববর্তী এক মাসের মধ্যে শারীরিক শাস্তির শিকার হয়েছে। জরিপে আরো দেখা যায়, ৩৫ শতাংশ অভিভাবক মনে করেন শিশুকে শাস্তি প্রদানের প্রয়োজন আছে। বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শাস্তি নিষিদ্ধ করতে ২০১১ সালে একটি পরিপত্র জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তারপরও শিশুরা শিক্ষকদের দ্বারা মারধর ও অপমানের শিকার হচ্ছে। তাছাড়া বাড়ি, প্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্র ইত্যাদিতেও শিশুদের শাস্তি দেয়া হয়।
শারীরিক ও মানসিক শাস্তির কুফল
শারীরিক শাস্তি বলতে এমন শাস্তিকে বোঝায় যেখানে কোনো না কোনো মাত্রার ব্যথা বা অস্বস্তি প্রদানের উদ্দেশ্যে শারীরিক বল প্রয়োগ করা হয়। নিষ্ঠুর ও অবমাননাকর আচরণ এ ধরণের শাস্তির অন্তর্ভুক্ত। বাংলাদেশের মা-বাবা, শিক্ষকসহ অনেকের মাঝেই ভুল ধারণা রয়েছে যে, শাস্তি শিশুদের সঠিক আচরণ করতে শেখায়। শাস্তি শিশুর মানবিক মর্যাদা ক্ষুন্ন করে এবং নিঃসন্দেহে শিশু অধিকারের ভয়াবহ লঙ্ঘন।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা প্রকাশিত ফ্যাক্ট শীট “কর্পোরাল পানিশমেন্ট অ্যান্ড হেলথ” (নভেম্বর, ২০২১) শিশুদের শারীরিক শাস্তি নিয়ে বিভিন্ন গবেষণার সারাংশ তুলে ধরেছে, এবং শাস্তির অবসানের আহবান জানিয়েছে। ফ্যাক্ট শীট অনুযায়ী,অসংখ্য গবেষণায় স্বল্প এবং দীর্ঘমেয়াদে শাস্তির সঙ্গে নিম্নলিখিত নেতিবাচক বিষয়গুলির প্রত্যক্ষ সম্পর্ক প্রমাণিত হয়েছেঃ
শারীরিক ক্ষতি; দীর্ঘমেয়াদী প্রতিবন্ধিতা বা মৃত্যু; ক্যান্সার,মাইগ্রেন, হৃদযন্ত্রের রোগ, আর্থ্রাইটিস এবং ওজন বেড়ে যাওয়া ; মানসিক অসুস্থতা যার মধ্যে আছে আচরণগত এবং উদ্বেগ সংক্রান্ত ডিজঅর্ডার, বিষন্নতা, হতাশা, নিজের ক্ষতি করা এবং আত্মহত্যার চেষ্টা; অ্যালকোহল এবং মাদকাসক্তি; আবেগ নিয়ন্ত্রণ এবং দ্বন্দ্ব নিরসনে দক্ষতার ঘাটতি; বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়া এবং শিক্ষা ও পেশাগত জীবনে কম সফল হওয়া; শিশুদের মধ্যে আগ্রাসী আচরণ; অপরাধপ্রবণতা; অন্যান্য ধরণের সহিংসতা মেনে নেয়া; পারিবারিক সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ইত্যাদি।
গ্লোবাল পার্টনারশীপ টু এন্ড ভায়োলেন্স এগেইন্সট চিল্ড্রেন প্রকাশিত “করপোরাল পানিশমেন্ট অফ চিল্ড্রেনঃ সামারী অফ রিসার্চ অন ইটস ইম্প্যাক্ট অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েশনস” (অক্টোবর, ২০২১) জানাচ্ছে যে, ৩০০ টির বেশি গবেষণা শাস্তির সঙ্গে অসংখ্য নেতিবাচক ফলাফলের সম্পৃক্ততা প্রমাণ করেছে। কোন গবেষণায় শাস্তির কোন সুফল পাওয়া যায়নি।
মা-বাবা এবং শিক্ষকদের শিশুরা সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করে। তারা যখন শাস্তি দেয় তখন শিশুরা ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে নির্যাতনকে স্বাভাবিক মনে করে, মেনে নিতে শেখে। শাস্তি পাওয়া শিশুরা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরে নিজেরাও নির্যাতন করবে অথবা নির্যাতনের শিকার হবে - এমন আশঙ্কা বেড়ে যায়। আমরা যদি শিশুদের শাস্তি দেওয়া বন্ধ না করি তাহলে সমাজে সহিংসতার চক্র ভাঙা অসম্ভব হয়ে পড়বে।
৬৮ টি দেশ সবক্ষেত্রে শিশুদের শাস্তি নিষিদ্ধ করেছে
শিশুদের জীবনে ক্ষতিকর প্রভাব প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও অনেক দেশে এখনো শাস্তি আইনসম্মত। তথাকথিত “শৃঙ্খলা”র নামে এ ধরনের শাস্তির বৈধতা দেয়া হচ্ছে। যে আইন শিশুদের শাস্তিদানকে অনুমোদন করে তা বৈষম্যমূলক। এর ফলে আইনের চোখে শিশুদের সমতার অধিকার লঙ্ঘিত হয়; তাদের বড়দের অধীনস্ত বলে মনে করা হয়।
পৃথিবীর ৬৮ টি দেশ সবক্ষেত্রে (বাড়ি, বিদ্যালয়, কর্মক্ষেত্র, বিকল্প শিশু পরিচর্যা কেন্দ্রসহ সব ধরনের প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি) শিশুদের শাস্তি নিষিদ্ধ করে আইন করেছে। বাংলাদেশ এখনো এই তালিকায় নেই।
আইনত নিষিদ্ধ হলে শাস্তি কমে
গবেষণায় দেখা যায়, শারীরিক শাস্তি পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা হলে এবিষয়ে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটে এবং সময়ের সাথে সাথে এর ব্যাপকতা কমতে থাকে। সুইডেন এর একটি উদাহরণ। ১৯৭৯ সনে বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে শিশুদের সব ধরনের শাস্তি নিষিদ্ধ করে সুইডেন। নতুন আইন সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে দেশটিতে বড় আকারের গণশিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। তাছাড়া মা-বাবারা শিশু ও প্রসূতি ক্লিনিকগুলো থেকেও সহায়তা ও তথ্য পায়। নিষিদ্ধ করার পর থেকে বয়স্কদের মধ্যে শাস্তির অনুমোদন ও ব্যবহার ধারাবাহিকভাবে কমে আসে। ১৯৭০ এর দশকে দেশটির প্রায় অর্ধেক শিশু নিয়মিত শাস্তির শিকার হত, যা কিনা ১৯৮০ এর দশকে এক-তৃতীয়াংশে এবং ২০০০ সালের পর মাত্র কয়েক শতাংশে নেমে এসেছে।
বাংলাদেশে শিশুদের শাস্তি বিলোপে কিছু সুপারিশ
শাস্তির অবসান হলে তা শিশুদের বিকাশ, শিক্ষা এবং কল্যাণে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে, এবং গার্হস্থ্য সহিংসতা হ্রাস ও জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে সহায়তা করবে। ২০৩০ সনের মধ্যে সব ধরণের শিশু নির্যাতন অবসানে বিশ্বকে যদি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য ১৬.২ পূরণ করতে হয় তবে শাস্তি বিলোপ অপরিহার্য। এজন্য বাংলাদশে যা করা প্রয়োজন তা হলঃ
- সকল ক্ষেত্রে (বাড়ি, বিদ্যালয়, কর্মক্ষেত্র, বিকল্প শিশু পরিচর্যা কেন্দ্রসহ সব ধরনের প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি) শিশুদের শাস্তি নিষিদ্ধ করে একটি নতুন আইন প্রণয়ন করতে হবে।
-নীতিমালা, কর্মসূচী ও জনসচেতনতামূলক প্রচারণার মাধ্যমে আইনি নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা এবং এর বাস্তবায়ন যথাযথভাবে হচ্ছে কিনা তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
-শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শাস্তি নিষিদ্ধকরণে সরকার যে পরিপত্র জারি করেছে তার বাস্তবায়ন ও যথাযথ মনিটরিং করতে হবে।
-শাস্তি না দিয়ে ইতিবাচকভাবে শিশুদের বড় করা ও শিক্ষা-প্রদান সম্পর্কে মা-বাবা এবং শিক্ষকদের দক্ষতা বাড়াতে হবে। পরিবার ও শিশুদের নিয়ে বা তাদের জন্য স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক সেবা খাতে যারা কাজ করেন তাদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচীগুলোতে এ সংক্রান্ত তথ্য অন্তর্ভুক্ত করা দরকার।
-শিশুদের মতামতকে সম্মান প্রদর্শন করতে হবে এবং শাস্তি বন্ধের প্রক্রিয়ার বিভিন্ন ধাপে শিশুদের কথা শোনা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
শিশুরা বয়সে ছোট, কিন্তু তাদের মানবাধিকার কারো চেয়ে কম নয়।আসুন সকল ক্ষেত্রে শিশুদের শারীরিক শাস্তি আইন করে নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি একে সামাজিকভাবে অগ্রহণযোগ্য করে তুলি। শিশুদের পরিপূর্ণ মানুষের মর্যাদা দিতে শিখি।
মন্তব্য করুন: