প্রকাশিত:
১০ জুন ২০২৫, ১৪:০৮
জামালপুরের বকশীগঞ্জের বান্দেপাড়া এলাকার পাটখেত থেকে গত ১৬ মে এক নারীর পোড়া লাশ উদ্ধার করেছিল পুলিশ। মুখমণ্ডল পুড়ে যাওয়ায় ওই নারীর নাম-ঠিকানা নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছিল না। ওই ঘটনায় জড়িতদেরও শনাক্ত করতে পারছিল না পুলিশ। শেষ পর্যন্ত ওই নারীর মাথায় আগের কাটা চিহ্নের সূত্র ধরে তাঁর নাম-ঠিকানা নিশ্চিত হয়ে হত্যায় জড়িত অভিযোগে একজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
ওই নারীর নাম নবিরন খাতুন (৫২)। বাড়ি জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জের চেংটিমারী পূর্ব এলাকায়। পেশায় পোশাকশ্রমিক এই নারী থাকতেন রাজধানীর খিলগাঁও এলাকায়।
এ ঘটনায় দায়ের করা মামলার তদন্তের সঙ্গে যুক্ত জামালপুরের পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, ঢাকার দুই সন্ত্রাসীকে ৩০ হাজার টাকায় ভাড়া করে নবিরনকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করেন তাঁর জামাতা আবু তালেব মণ্ডল (৪৭)। লাশ যাতে চেনা না যায়, সে জন্য পুড়িয়ে দেওয়া হয়। বকশীগঞ্জ ও দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার সীমান্তবর্তী এলাকায় লাশটি পাওয়া যায়। পরে তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় অবস্থান নিশ্চিত হয়ে ৪ জুন রাতে ঢাকার সাভারের একটি এলাকা থেকে আবু তালেবকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি জামালপুরের আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন বলে পুলিশ জানায়।
কাটা চিহ্নের সূত্র ধরে যেভাবে পরিচয় শনাক্ত
পাটখেত থেকে উদ্ধার নবিরনের লাশটির মুখ, গলা ও বুক পোড়া ছিল। ওই ঘটনায় বকশীগঞ্জ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. আনিছুর রহমান বাদী হয়ে থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। মামলায় বলা হয়, ১৫ মে দিবাগত রাত সাড়ে ১২টা থেকে ৩টার মধ্যে অজ্ঞাতনামা দুষ্কৃতকারীরা পূর্বশত্রুতার জের ধরে ওই নারীকে হত্যা করে লাশ গুম করার চেষ্টা করেছেন।
মামলার তদন্ত তদারকের সঙ্গে যুক্ত জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, আঙুলের ছাপ মিলিয়েও নিহত নারীর পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছিল না। হত্যাকাণ্ডের তেমন কোনো সূত্র ছিল না পুলিশের কাছে।
তদন্তের এক পর্যায়ে স্থানীয় এক স্কুলশিক্ষক পুলিশকে জানান, গত মে দিবসের দিন এক নারীর মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিলেন আবু তালেব। আর পুলিশের করা সুরতহাল প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে, নিহত নারীর মাথায় ছয় ইঞ্চি গভীর কাটা চিহ্ন রয়েছে। এ নিয়ে পুলিশের সন্দেহের সৃষ্টি হয়। পুলিশ খোঁজ নিয়ে জানতে পারে, ওই নারী বকশীগঞ্জের একটি ওষুধের দোকান থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন। কিন্তু আবু তালেবকে এলাকায় খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাঁর ছেলের কাছ থেকে আবু তালেবের মুঠোফোন নম্বর নিয়ে যোগাযোগ করলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়।
পুলিশ অনুসন্ধান করে জানতে পারে, নবিরনের একমাত্র মেয়ে বিলকিস বেগম রাজধানীর খিলগাঁওয়ে থাকেন। তাঁর মুঠোফোন নম্বর সংগ্রহ করে যোগাযোগ করে পুলিশ জানতে পারে, অনেক দিন ধরে তাঁর মা নিখোঁজ রয়েছেন। এর আগে তাঁর মায়ের মাথায় ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করেছিলেন আবু তালেব। তখন পুলিশের কাছে বিষয়টি অনেকটা পরিষ্কার হয়।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, তখন বিলকিসের কাছ থেকে আবু তালেবের মুঠোফোন নম্বর নিয়ে তাঁর অবস্থান শনাক্ত করে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। হত্যায় অংশ নেওয়া অপর দুজনকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে যাওয়ায় হত্যার পরিকল্পনা
জিজ্ঞাসাবাদে নবিরনকে ছুরিকাঘাত করে হত্যার কথা স্বীকার করে আবু তালেব পুলিশকে বলেন, এ জন্য তিনি ঢাকা থেকে দুজন সন্ত্রাসী ভাড়া করেন। ভাড়া করা দুজনসহ মিলে তাঁরা নবিরনকে ছুরিকাঘাত হত্যা করেন। লাশ যাতে শনাক্ত করা না যায়, সে জন্য পুড়িয়ে দেওয়া হয়। ঘটনার পর তিনি সাভারে গিয়ে অটোরিকশা চালানো শুরু করেন। কিন্তু সেটি কাউকে জানাতেন না।
আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে আবু তালেব বলেন, ‘আমার স্ত্রী বিলকিসকে নিয়ে যাতে সংসার করতে না পারি, সে জন্য যা যা করার দরকার, সবই শাশুড়ি (নবিরন) করতেন। আর আমার স্ত্রীও তাঁর মায়ের কথা শুনতেন। আমার স্ত্রী আমাকে ছেড়ে ঢাকায় চলে যান। পরে আমার সন্তানদেরও আমার শাশুড়ি ঢাকায় নিয়ে যান। এতে আমি ক্ষুব্ধ হয়ে অমার শাশুড়িকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নিই। আমার শাশুড়িকে মেরে ফেলার জন্য ঢাকায় দু্ই সন্ত্রাসীকে ৩০ হাজার টাকায় ভাড়া করি।’
আবু তালেব আদালতকে বলেন, ‘গত ১৫ মে আমার শাশুড়ি ঢাকা থেকে জামালপুর আসেন। এই খবর পেয়ে ভাড়া করা দুই সন্ত্রাসীও জামালপুরে আসেন। ওই দিন সন্ধ্যা সাতটার দিকে আমার শাশুড়ি স্থানীয় বাজারে মুঠোফোন কিনতে যাচ্ছিলেন। তখন আমি তাঁকে বলি, চলেন আমি আপনাকে সোজা পথে নিয়ে যাব। এ কথা বলে ভাড়া করা দুই সন্ত্রাসীসহ আমি এবং আমার শাশুড়ি একটি রিকশায় (রিকশাভ্যান) উঠি। কিছু দূর যাওয়ার পর ভ্যান থেকে নেমে পড়ি এবং চালককে ভ্যান নিয়ে চলে যেতে বলি।’
আবু তালেব জবানবন্দিতে আরও বলেন, ‘এরপর তাঁকে (শাশুড়ি) একটি প্লটে নিয়ে যাই। তখন আমরা তাঁকে ঘিরে ধরি। তখন শাশুড়ি বলেন, তাঁর কাছে টাকা ও চেক আছে। এগুলো নিয়ে যেতে অনুরোধ করে বলা হয়, তাঁকে যেন মেরে না ফেলা হয়। তখন দুই সন্ত্রাসী আমার শাশুড়ির গলায় ওড়না লাগিয়ে পেঁচিয়ে ধরেন। এঁদের একজন মাথা, হাত ও পায়ে ছুরিকাঘাত করেন। তাঁরা টাকার ব্যাগ ছিনিয়ে নেন। তখন আমার শাশুড়ির মুখ চেপে ধরি আমি।’
আবু তালেব আরও বলেন, ‘এ সময় আমি দুজনকে ১ হাজার ৩০০ টাকা দিই। বাকি টাকা পরে দিতে চাই। মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর লাশ পাটখেতে নিয়ে আগুন ধরিয়ে আমরা চলে যাই।’
তবে পরীক্ষা-নিরীক্ষার বরাত দিয়ে পুলিশ কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম বলেন, নবিরনকে ধর্ষণের আলামতও পাওয়া গেছে। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা বকশীগঞ্জের কামালের বাত্তি তদন্তকেন্দ্রের উপপরিদর্শক (এসআই) মো. রফিকুল ইসলাম জানান, নবিরনকে হত্যার ঘটনায় একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অন্যদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
মন্তব্য করুন: