প্রকাশিত:
১৮ জুন ২০২৫, ১২:৪৩
বরগুনা—দক্ষিণাঞ্চলের নিরীহ এক জেলা। কিছুদিন আগেও আলোচনার কেন্দ্রে ছিল না। অথচ এখন সারাদেশের নজর এই জেলার দিকে। কারণ, স্বাস্থ্য অধিকার সংগঠন বরগুনাকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘ডেঙ্গু হটস্পট’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। অথচ মাঠে তেমন কোনো প্রতিরোধমূলক কার্যক্রম চোখে পড়ে না। নেই পর্যাপ্ত চিকিৎসা ব্যবস্থা, নেই স্থানীয় প্রশাসনের সমন্বিত উদ্যোগ। বরগুনাবাসী একপ্রকার নিজেদের ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিয়েছে জীবন।
চিত্র ভয়াবহ, আতঙ্ক সর্বত্র
চলতি বছরে এখন পর্যন্ত বরগুনা জেলায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে প্রায় ২,০০০ জনের বেশি, এবং মৃত্যু হয়েছে ১৫ জনের, যার মধ্যে রয়েছে শিশুসহ বয়স্করা। একদিকে রোগীর চাপ, অন্যদিকে হাসপাতাল ও চিকিৎসা ব্যবস্থার দুর্বলতা মিলিয়ে পরিস্থিতি রীতিমতো জরুরি স্বাস্থ্য সংকটে পরিণত হয়েছে।
বরগুনা সদর হাসপাতালের এক নার্স নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন:
“একটা বেডে দুইজন রোগী, এমনকি ফ্লোরেও জায়গা নেই। রক্ত পরীক্ষার কিট কম, ডাক্তারের সংকট—সব মিলিয়ে আমরা নিজেরাই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছি।”
ডাক্তারের চোখে বাস্তবতা
বরগুনা সদর হাসপাতালের অভিজ্ঞ মেডিসিন চিকিৎসক ডা. শামীম আহমেদ, বলেন “ডেঙ্গু এখানে মহামারি রূপ নিয়েছে। আমরা প্রতিদিন গড়ে ৫০ থেকে ৭০ জন নতুন রোগী ভর্তি নিচ্ছি। কোনো নির্দিষ্ট আইসোলেশন ওয়ার্ড নেই। রোগী ও তার স্বজনরা আতঙ্কে ভুগছে।”
সাধারণ মানুষের হৃদয়বিদারক অভিজ্ঞতা
বেতাগী উপজেলার কৃষক মো. ছালাম বয়াতী বলেন: “আমার মেয়েটা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে বরগুনা সদর হাসপাতালে ভর্তি। ওষুধ, রক্ত পরীক্ষা, থাকার খরচ সব মিলিয়ে ২০ হাজার টাকা খরচ হয়ে গেছে। আমরা গরিব মানুষ, এখন তো গরুটা বিক্রি করতে হবে।”
পাথরঘাটা উপজেলার এক নারী, রাবেয়া খাতুন, কাঁদতে কাঁদতে বলেন: “ডাক্তাররা চেষ্টা করছে, কিন্তু এত রোগীর ভিড়ে কার আগে কার চিকিৎসা দেবে ওরা? আমার দেবর দুই দিন ধরে ফ্লোরে পড়ে ছিল।”
প্রশাসনের দায় এড়ানোর চেষ্টা?
বরগুনা পৌরসভার একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন: “আমরা চেষ্টার ত্রুটি করছি না। কিন্তু কেবল পৌরসভার পক্ষে তো সম্ভব নয় পুরো শহর মশামুক্ত করা। জনগণেরও সচেতনতা দরকার।”
তবে সাধারণ মানুষ বলছে অন্য কথা।
আমতলীর এক শিক্ষক আমিনুল হক বললেন: “আমরা প্রশাসনের কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ দেখিনি। শুধু পোস্টার লাগিয়ে দায়িত্ব শেষ করলে হবে না। দরকার মাঠপর্যায়ে কাজ।”
বিশ্লেষক বলছেন: ‘প্রশাসনিক উদাসীনতার ফল এই বিপর্যয়’
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্য গবেষক ড. মাহমুদা খাতুন বলেন: “বরগুনার ডেঙ্গু পরিস্থিতি এটাই প্রমাণ করে যে, প্রশাসনিকভাবে আমরা প্রস্তুত ছিলাম না। এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী দীর্ঘদিনের অবহেলা, জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার দুর্বলতা এবং পরিকল্পনার অভাব।” তিনি আরও বলেন: “উপকূলীয় এলাকায় জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মশার বিস্তার বাড়ছে, কিন্তু সেই অনুযায়ী জনস্বাস্থ্য বাজেট বা লোকবল বাড়ানো হয়নি।”
তথ্য যখন চোখে আঙুল দিয়ে দেখায় অব্যবস্থার চিত্র
২০২২ সালে ডেঙ্গু আক্রান্ত ৪৫৮ জন, ২০২৩ সালে ১৪৬৫ আক্রান্ত ও মৃত্যুবরণ করে একজন, ২০২৪ সালে আক্রান্ত ২০৫০ জন ও করেন তিনজন। ২০২৫ সালে আক্রান্ত (মে–জুন) ১,৯৮৫ জন মৃত্যুবরণ করেন ১৫ জন।
সমাধানের ৫টি জরুরি প্রস্তাব
১. প্রতিটি উপজেলা হাসপাতালে ডেঙ্গু আইসোলেশন ইউনিট চালু করা।
২. গ্রাম পর্যায়ে সচেতনতা ক্যাম্পেইন ও মশা নিধন কার্যক্রম পরিচালনা।
৩. স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বরাদ্দ বাড়ানো ও র্যাপিড মেডিকেল রেসপন্স টিম গঠন।
৪. বেসরকারি হাসপাতাল ও স্বেচ্ছাসেবক সংস্থাকে যুক্ত করা।
৫. জেলার প্রতিটি স্কুল-কলেজে শিক্ষার্থীদের সচেতনতা প্রশিক্ষণ।
স্বাস্থ্য অধিকার কর্তৃক বরগুনাকে হটস্পট বলা মানেই, এ জেলাকে এখন সর্বোচ্চ সতর্কতার আওতায় আনা প্রয়োজন। কেবল কাগজে হটস্পট লেখা দিয়ে কাজ হবে না, বরং বাস্তব পদক্ষেপ নিতে হবে আজই। না হলে এই নীরব মহামারি কাল হয়ে উঠবে পুরো উপকূলবাসীর জন্য।
মন্তব্য করুন: